Monday, September 29, 2014

জাসদ

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল---জাসদ

1) তাহের হত্যা, ৭ই নভেম্বর :: অসমাপ্ত বিপ্লব
মূলত ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই প্রথম “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা” এবং “বিপ্লবী গণবাহিনী” প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। দুটি সংগঠনই মুক্তিযুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে নেতৃত্বদানকারী-অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। তৎকালীন সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অনেকেই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিলেন, এবং বিদেশী গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগসাজশ ছিল তাদের। যারা ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ সিপাহী ছিলেন। তাদের সাহস, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের যে গুণাবলী লক্ষ্য করা গেছে, তা ঐ বিদ্রোহের এক বিশিষ্ট উত্তরাধিকার হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। LINK
1-a) শেখ মুজিবকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তাহের। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের আভাসও দিয়েছিলেন তাহের। কিন্তু কোনো সতর্কতা কাজে আসেনি, হত্যাকারীরা সফল হয়েছিল। সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে একের পর এক সেনা ক্যু সংঘটিত হতে থাকে। এমতাবস্থায় দেশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কর্নেল তাহের ও তার সহযোদ্ধারা।
1-b) ৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এবিএম মাহমুদের বাসায় শুরু হয় জাসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আফম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসুদ, কাজী আরেফ প্রমুখ। আরো ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখ। তৎকালীন অন্যতম প্রধান দল জাসদ, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত ছিল, তাদের যাত্রা প্রথমে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শেখ মুজিব সরকারের সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষতঃ রক্ষীবাহিনী কর্তৃক দলের প্রায় ২৬ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা, নির্যাতনের কারণে এবং দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হন খালেদ মোশারফ। সে সময়ে সিপাহীরা স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, তাদের কেবলই ব্যবহার করা হচ্ছে, কিছু গোষ্ঠির হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে। ফলশ্রুতিতে সৈনিকরা ক্রমেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল।
1-c) ৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫ -এর প্রেক্ষাপট =====>> 

আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় কমরেডদের সাথে মিটিং চলাকালে তাহের জানান, ২ তারিখ রাতে জেনারেল জিয়া তার জীবন রক্ষা করে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য ফোনে ও পরে এক সুবেদারের মাধ্যমে এসওএস ম্যাসেজের মাধ্যমে অনুরোধ করেন। ন্যাশনালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে তার একটা ইমেজ থাকায় তাহের জিয়াকেই সর্বাপেক্ষা উপযোগী বলে মনে করেন। তাহের জানান যে, জাসদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার নীরব সমর্থন রয়েছে। তৎকালীন সময়ে জিয়ার পক্ষে জাসদের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না। গৃহবন্দি জিয়াকে যে কোন সময়ে হত্যা করা হতে পারে, আর তাকে সে অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারে কেবল কর্নেল তাহের। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, অভ্যুত্থান সফল হলে বিজয়ী সিপাহি জনতা কার নামে স্লোগান দেবে, জিয়ার নামে। কারণ, তাহের অনেক আগেই আর্মি থেকে রিটায়ার্ড, ক্যান্টনমেন্টে তার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে, জাসদের বড় নেতাদের মধ্যে জলিল, রব, শাজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। জিয়া আর্মির লোক, তাকে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিকেরা মুক্ত করেছে, তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি ছিল। ঠান্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছক তৈরি করেন তাহের। আসলো সেই ৭ই নভেম্বরের রাত। মধ্য রাতের পর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয় আর এর দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার হাই। তিনি ২০/৩০ জন সিপাই নিয়ে জিয়ার বাসভবনে যান। তারা স্লোগান দিতে দিতে আসেন ‘কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম’।

1-d) জাসদের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ =======>>

১৯৭২ সালের ২৩ জুলাই আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ আসম রব ও শাজাহান সিরাজ এবং নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপে আনুষ্ঠানিকভাবে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম গ্রুপ পল্টন ময়দান এবং দ্বিতীয় গ্রুপ রমনা রেসকোর্সে সম্মেলন আহ্বান করে এবং দুটি গ্রুপই শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু শেখ মুজিব সিদ্দিকী-মাখন গ্রুপের সম্মেলনে যোগ দিলেন, আর সেই থেকে ছাত্রলীগ ‘মুজিববাদী’ ও ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ নামে দুটি আলাদা সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ স্লোগান নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল - জাসদ গঠিত হয়। জাসদের ছাত্র সংগঠনের নামও তারা রাখেন “ছাত্রলীগ”, যা জাসদ-ছাত্রলীগ নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আওয়ামী দুঃশাসনে জনগণ অতীষ্ট হয়ে পড়েছিল, ছাত্র রাজনীতির অঙ্গন বা ক্যাম্পাস রাজনীতিতেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সদস্য, এমনকি শিক্ষকরা পর্যন্ত ছিল মুজিববাদী ছাত্রলীগারদের কাছে জিম্মি। এমতাবস্থায় জাসদ’র গঠন তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর আরেকটা বড় কারণ ছিল প্রগতিশীল নামধারী বাম দল সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের আওয়ামী লেজুরবৃত্তিমূলক কর্মকাণ্ড। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রগতিশীল চিন্তার শিক্ষার্থীরা বিকল্প হিসেবে বেছে নেয় জাসদের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’।
1-e) জাসদ চেয়েছিল যেকোনো মূল্যে শেখ মুজিব সরকারের পতন, যেন এতেই ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের মুক্তি নিহিত! আর সেই কাজটি সপরিবার শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অন্য কেউ করে ফেলায় জাসদ কর্মহীন হয়ে পড়ে অনেকাংশেই, যেহেতু তাদের কর্মপদ্ধতি সর্বোতভাবে আওয়ামী রাজনীতিকে টেক্কা দেওয়াতেই নিয়োজিত ছিল। জনগণের প্রকৃত মুক্তির পথে তারা কাজ করেনি, তাই জনভিত্তিও মজবুত করা সম্ভব হয়নি। আর রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিজেরাই বিভ্রান্তিতে থাকায় এই বিপ্লবী (!) নেতাদের কেউ বিএনপিতে সমর্পিত হয়েছেন, কেউ বা আওয়ামী লীগের কোলে চড়েছেন। আবার কেউ স্বৈর-সামরিক শাসকের পদলেহী হয়েছেন।

1-f) জাসদের রাজনীতি // নজরুল ইসলাম  ======>> 

শেখ মুজিব জীবিত থাকতে জাসদের আন্দোলনের কৌশল ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন। (১৯৭৪ সালে গৃহীত থিসিস)। ‘কিন্তু দুই বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে আন্দোলনের চেহারাটা বদলে যায়। এবার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ না, কী করে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে একটা সরকার গঠন করা যায়, সেটাই জনাব খানের (সিরাজুল আলম খান) আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়ে। তাঁর মনোযোগ নিয়োজিত হয় একটা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি। (জাসদের রাজনীতি, নজরুল ইসলাম )
1-g) ১৯৮০ সালে জাসদ ঘোষিত ১৮ দফা কর্মসূচিতে আরও গণতন্ত্র, ২০০ আসনের পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বসহ ৫০০ আসনের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। 
1-h) ১৯৮০ সালে ১৮ দফা কর্মসূচি প্রশ্নে জাসদ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দলের একাংশ দল থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল - বাসদ নামে নতুন দল করে। পরে বাসদও দুই ভাগ হয়ে যায়।
1-i) তবে বর্তমানকালের জাসদ নামক দলটির সাথে তৎকালীন জাসদ’কে গুলিয়ে ফেলাটা সঠিক হবে না, আর এর মূল কারণ হলো - সে সময়ে দলটির নিদেন পক্ষে একটা জাতীয় চরিত্র বিদ্যমান ছিল, এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল হাজারো ত্যাগী কর্মী-সমর্থক, যা বর্তমানে একেবারেই অনুপস্থিত, বর্তমানে এই দলটি বিশেষভাবে শাসকশ্রেণীর দালালীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত!
1-j) অন্যান্য বিপ্লবী কমিউনিস্ট দলগুলো যখন দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে তুলছিল, তখন জাসদ, আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিতেই গলদঘর্ম। তারা ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলেও মতাদর্শিত-তাত্ত্বিক অস্বচ্ছতার জন্য তারা জনভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। বিশাল কর্মী বাহিনী থাকার পরেও ব্যাপক নিপীড়িত জনগণের মাঝে কাজের প্রতিফলন ঘটাতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। মূলতঃ দলের প্রকাশ্য নেতারা আত্মগোপনে গিয়ে সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। আর এই বাহিনী গঠনের ক্ষেত্রেও দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মাওবাদী (তৎকালীন সময়ে মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা) পন্থা অনুসরণ করা হয়নি। ফলে বাহিনী নামে “গণবাহিনী” হলেও তা গণ-মানুষের দ্বারা গঠিত গণ-মানুষের বাহিনী হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চের পর জাসদের প্রকাশ্য তৎপরতাও অনেকাংশে কমে যায়। শাজাহান সিরাজের ভাষ্য মতে, “বস্তুত ১৭ মার্চ ১৯৭৪-এ আমরা কী করতে চেয়েছিলাম? তখনকার সাহিত্যগুলো খুঁজে দেখলে মূলত একটি জবাব বেরিয়ে আসবে। চেয়েছিলাম গণ-আন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে।” (জাসদের আত্মসমালোচনামূলক দলিল, ১৯৭৯) তিনি আরো বলেন, “১৭ মার্চের ঘটনার পর জনগণ ও আমাদের মাঝে সৃষ্টি হয় যোগসূত্রহীনতা। বস্তুত ১৭ মার্চের পর আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।” (রাজনৈতিক রিপোর্ট, ১৯৮০ শাজাহান সিরাজ) LINK

No comments:

Post a Comment